বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৬ অপরাহ্ন
ক্রমেই দেশব্যাপী বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। যদিও জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে ছিল ডেঙ্গু পরিস্থিতি। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে আক্রান্ত হয় ৩৫২ জন। মাসে গড় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭০.৪ জন। জুন মাসে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। জুনে আক্রান্ত হয় ৭৩৭ জন। জুলাই মাসে রোগীর সংখ্যা হয়ে যায় ডাবলেরও বেশি। এমাসে আক্রান্ত হয় এক হাজার ৫৭১ জন। আগস্ট মাসে সারাদেশে সেই রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৫২১ জন। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে পারে।
ডেঙ্গুর বর্তমান আক্রান্তের অবস্থা বিবেচনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সাফ জানিয়ে দিয়েছে, মশা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সম্ভব হবে না। ঢাকার দুই সিটি (দক্ষিণ ও উত্তর) করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ডেঙ্গুরোগ প্রতিরোধে মশার বিস্তার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নগরবাসীকে আরও সচেতন হতে হবে। না হলে অভিযান চালিয়ে বা ওষুধ ছিটিয়ে এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, এবছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানী এবং সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৩৯৭ জন। এসব রোগীদের মধ্যে ঢাকায় ৬ হাজার ৪৮ জন এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় এক হাজার ৩৪৯ জন। এবছর ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৩১ জন।
এই বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, সাধারণত আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর এই দুই মাস ডেঙ্গুর জন্য পিক সিজন। কিন্তু এবছর জুন থেকেই ক্রমে সংক্রমণ বাড়ছে। যদিও অক্টোবরের প্রথম দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাবে। সিটি করপোরেশনের তরফ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও, নগরবাসী সচেতন না হলে; সহযোগিতা না করলে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া একটু কঠিনই হবে। যদিও অন্য বছরের তুলনায় এবছরে ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কম বলে জানান এই কর্মকর্তা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর এই বিষয়ে বলেন, ময়লা আবর্জনাযুক্ত ড্রেনের পানিতে এডিস মশা জন্মায় না। বরং এই মশা জন্মায় অল্প ও স্বচ্ছ পানিতে। তাই প্রত্যেকে নিজের বাসা-বাড়ির জমে থাকা পানি পরিষ্কার করে ফেললে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে ডেঙ্গু আক্রান্ত কম হবেন। এ ব্যাপারে প্রত্যেক নগরবাসীকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, ২০২১ সালের আগস্ট পুরো মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৬৯৮ জন। এবছরের আগস্টে রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৩৭০ জন। অর্ধেকেরও কম। তেমনি গত বছরের সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৮৪১ জন। বর্তমান সেপ্টেম্বর মাসে সর্বোচ্চ ৫ হাজার রোগী হতে পারে বলে ধারনা করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ধারণার সঙ্গে বাস্তবের চিত্র মেলানো যাচ্ছে না। সংক্রমণের যে ঊর্ধ্বমুখী চিত্র দেখা যাচ্ছে, সে হিসেবে আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বর মাসে সংক্রমণ বাড়বে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনজুর রাহমান বলেন, ডেঙ্গু সংক্রমণ সাধারণত আগস্ট মাস থেকে বাড়া শুরু হয়। সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করে অক্টোবর মাসে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। গত কয়েক বছর ধরে এভাবেই চলে আসতে দেখা গেছে। আমাদের দেশে ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। সেবছর সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১৬ হাজার ৮০০ জন। যা পরের অক্টোবর মাসে ৮ হাজারে নেমে আসে। তাই সেপ্টেম্বর মাস আমাদের জন্য বেশ রিস্কি বলা যায়।
ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. শাতিল মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, ডেঙ্গু রোগ মূলত যে মশার কামড়ে হয়, সেই মশা আর গ্রামের মশা এক নয়। শহরের এসব মশা অল্প পানিতে ডিম পাড়ে এবং জন্মাতে পারে। যেমন- ডাবের খোসা, ফুলের টব, এগুলোতে খুব অল্প পরিমাণ পানি থাকলেও এর মধ্যেই মশা জন্মাতে পারে। ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। কনস্ট্রাকশনের কাজ করার সময় ওই এলাকায় ড্রামসহ বিভিন্ন কৌটা আর খানাখন্দে পানি জমে থাকে। যা নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। যার ফলে সেসব পানিতে ডেঙ্গু মশার বংশ বিস্তার হয়।
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে অভিযান চালানো হচ্ছে। ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, নগরবাসীকে সচেতন করা হচ্ছে। নগরবাসী দায়িত্ব নিয়ে এসব মশার উৎপাদনের স্থানগুলো পরিষ্কার করলে, জমানো পানি নিয়মিত ফেলে দিলে মশার প্রজনন কমবে। এতে আক্রান্ত ও মৃত্যু হারও কমবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির সেন্ট্রাল রোডের স্থায়ী বাসিন্দা আসিফ ইকবাল বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে সাধারণত ওষুধ স্প্রে করে বিকেল বা সন্ধ্যায়। কিন্তু যতদূর জানি, ডেঙ্গু মশা সকালে কামড়ায়। আর ম্যালেরিয়া মশা কামড়ায় বিকেলে বা সন্ধ্যার পর। তাই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমানোর জন্য সকালবেলা স্প্রে করা দরকার। এ ছাড়াও চারপাশে অসংখ্য ভবন তৈরি হচ্ছে, যেখানে সিটি করপোরেশনের তেমন কোনও তদারকি নেই। সেসব ভবনের মালিকরাও উদ্যোগী হয়ে ঠিকমতো জমে থাকা পানি ফেলে দেন না। ফলে এসব পানিতে মশার জন্ম বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ছে এটা উদ্বেগের তেমনি এটাও ঠিক যে, গত বছরের তুলনায় এবছর সংক্রমণের হার কম। এ বছর ডেঙ্গুতে ৩১ জন মারা গেছেন। আমরা চাই না একটি মানুষও ডেঙ্গুতে প্রাণ হারাক। ডেঙ্গু আক্রান্ত সবার খবর আমরা পাই না। আমরা সেসব রোগীদের খবর পাই, যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। তাই, কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ভালো। হাসপাতালে থাকলে একটা সেবার মধ্যে থাকে এবং তার মৃত্যু ঝুঁকিটা কমে যায়।
অধ্যাপক নাজমুল বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুটি কাজ করে থাকে, প্রথমত হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেওয়া। সেটা ঠিকঠাকই করছে। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় আমাদের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে আপডেটেড আছেন। দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তরফ থেকে বিভিন্ন মৌসুমে ঢাকা মহানগরীতে সার্ভে করা হয়। সেই সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী উত্তর-দক্ষিণ দুই সিটিতেই সমানভাবে মশার উপদ্রব পেয়েছি।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১২৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, ফেব্রুয়ারি মাসে ২০ জন, মার্চ মাসেও ২০ জন, এপ্রিল মাসে ২৩ জন। এরপর মে মাস থেকে আবারও সংক্রমণ কিছুটা ঊর্ধ্বগামী হতে থাকে, ওই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ১৬৩ জন, জুন মাসে ৭৩৭ জন, জুলাই মাসে ১ হাজার ৫৭১ জন এবং আগস্ট মাসে ৩ হাজার ৫২১ জন। আর সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৮৫০ জন। এ পর্যন্ত (৬ সেপ্টেম্বর) মারা গেছেন ৩১ জন। ২০১৯ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংখ্যক আক্রান্ত হন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মারা যান ১৭৯ জন।